এক.
মরিয়ম বেগম হামেশাই ভোর রাতে উঠে ফজর নামাজের জন্যে, আজও উঠলো। ফজর নামাজ শেষে প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধা স্বামী ইমাম আলী ও সন্তান স্বপ্নিল সিদ্দিকীর জন্যে দোয়া করেন তিনি। কারণ তারা দু'জনেই গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, দেশ-মাতৃকাকে রক্ষার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে। তাদের এই সৎ বাসনা যাতে সফল হয়, সেজন্যে তিনি ঘরে বসে নামাজ শেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন।
নামাজ আদায় করে সালাম ফিরাতেই দেখলেন পাশের বাড়ির ইদু মুন্সী ও জামাল খাঁ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই মরিয়ম বেগমকে ওরা হিড়হিড় করে ধরে নিয়ে গেলো। একটা নির্জন, দুর্গন্ধময় ঘরে বন্দী করে রেখে রাতের অন্ধকারে তাকে নিয়ে গেলো রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার মির্জা আযমের কাছে।
লোকটার বিরাট বপু। মরিয়ম বেগমকে দেখে হাসলো সে। হাসলে তার পান খাওয়া দাঁতগুলো শুয়োরের মতো ঘোঁৎঘোঁৎ আওয়াজ করে। মরিয়ম বেগমকে উপহার দেয়ায় ইদু মুন্সী ও জামাল খাঁকে কিছু টাকা দিলো লোকটা। খুশি মনে ওরা চলে গেলো।
দুই.
কয়েক ঘণ্টা পরের কথা।
শরীরে অসহ্য নীল যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠলো মরিয়ম বেগম। তাকিয়ে দেখলো পাশে আরও চার-পাঁচজন মেয়ে প্রায় বিবস্ত্র বসে আছে। তাদের হাতে-পায়ে শেকল পরানো। সে ভালো করে দেখলো তার হাতে-পায়ে শেকল নেই। সে ক্রমে ক্রমে বারান্দায় এলো। হালকা আলোতে সেখানে যা দেখলো, তাতে যেনো ভিমড়ি খাবারই যোগাড়। বিবস্ত্র অবস্থায় কয়েকজন নারীকে টানিয়ে রাখা হয়েছে হাত-পা বেঁধে। কারো স্তন কেটে ফেলা হয়েছে, রক্ত ঝরছে। কারো সারা শরীরে কালো কালো দাগ- সম্ভবত সিগারেটের আগুনের। ওরা গোঙাচ্ছে, যেনো মৃত্যুকে আলিঙ্গনের অপেক্ষায় আছে। কেউ বিবস্ত্র শুয়ে আছে বারান্দায়, মৃতের মতো।
একটা বারো-তেরো বছর বয়সী বালক 'মা' 'মা' বলে ডাকছে, আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে একটা খামের সাথে। উদোম শরীর, ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন তার সারা গায়ে। যেনো কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে বলাৎকার করা হয়েছে- ব্যাপারটা এমনই মনে হলো তার কাছে।
এসব দৃশ্য অবলোকন করে মাথা ঘুরছে মরিয়মের। সে আর সামনে এগুতে পারলো না। ফিরে এলো সেই রুমটিতে।
বন্দীদের মধ্যে কেউ একজন মরিয়ম বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো, 'মহিলাটা এখনও বুঝতে পারেনি সে বন্দী। এখান থেকে পালাবার সব রাস্তা বন্ধ। তোমার জন্যে আরো ভয়াবহ নির্যাতন অপেক্ষা করছে। তুমি তৈরি থাকো।'
চারদিকে অবাক বিস্ময়ে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো মরিয়ম। মনে হলো, এটা পাকবাহিনীর দোসর রাজাকারদের বন্দী সেল। তার কাছে সব অস্পষ্ট লাগছে। সেই সাথে মনের ভেতর ছাইচাপা আগুন জ্বলে উঠছে ক্রমাগত। জীবনের সুখ-দুঃখের ভেলায় ভেসে ভেসে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে কোনোমতে প্রায় বেঁচেই ছিলো সে। তবুও একমাত্র ছেলে সন্তান স্বপ্নিল সিদ্দিকীকে নিয়ে আশার ভেলায় ভবিষ্যৎ সুখের স্বপ্ন ছিলো তার।
ভেবেছিলো ছেলেটাকে মানুষ করবে। ছেলেটি মানুষের মতো মানুষ হলে তার আর দুঃখ থাকবে না। কিন্তু জীবন বড়ই কঠিন। জীবনের সব ভাবনা সেলুলয়েডের ফিতার মতো একটার পর একটা নিয়ম মতো আসে না। মাঝে মাঝে অকল্পনীয় অশ্লীল দৃশ্যের অবতারণা হয়। হোঁচট খায় মানুষের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা। আর ভাবতে পারলো না সে। যন্ত্রণায় নীল হয়ে আসছে যেনো সারা শরীর। বসে পড়লো মেঝেতে।
তিন.
'আমরা আজ পতিত অতলস্পর্শরই অন্ধকারের বিস্তীর্ণ গর্ভে।' যেনো অস্ফুট কণ্ঠে সব মৌনতা ভেঙ্গে নৈশব্দের ঐন্দ্রজালিক মায়ামন্ত্রের মতো ঘোষণা করলো পাশে বসা একজন নির্যাতিত, নিষ্পেষিত নারী।
'হ্যাঁ, আমাদের জীবন আজ অন্ধকার অমানিশায় ভরে গেছে।' প্রতিধ্বনি তুললো আরেকজন।
'সারাদেশ-ই এখন অন্ধকারের আবর্তে, মীরজাফরের প্রেতাত্মারূপী দালালরা যুবতীসহ সব বয়সী ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে নিয়ে আসছে ক্যাম্পে।" ক্ষীণ অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলো আরও একজন নারী।
'নির্যাতন করতে করতে আমাদের অবশেষে মেরে ফেলা হবে।' উদাসভাবে চোখের অশ্রুবিন্দু বিসর্জন দিয়ে বললো অন্যজন।
এবার ধীরে ধীরে অনেক কষ্টে বসা থেকে উঠে বসলো মরিয়ম বেগম। নির্যাতিত, লাঞ্ছিত মেয়েদেরকে লক্ষ্য করে বললো সে, 'তাহলে আমরা কি এভাবেই তিলে তিলে নির্যাতিত হয়ে মরবো! না দেশের জন্যে বুক ফুলিয়ে জীবনদান করে শহীদ হবো?'
'আমরা শহীদ হবো।' চাপাস্বরে দৃপ্ত উচ্চারণ করলো সব বন্দী।
চার.
কমান্ডার মির্জা আযমের সামনে এইমাত্র ধরে আনা হলো মরিয়মের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ইমাম আলীকে। ইদু মুন্সী ও জামাল খাঁ তাকে দু'বাহু জড়িয়ে ধরে আছে। পেছনে রয়েছে তাদের আরো কয়েকজন সঙ্গী।
মির্জা আযম তাকালো ইমাম আলীর দিকে। লোকটার মাথায় টুপি। গালভর্তি দাড়ি। অবয়বে যেনো স্বর্গীয় দ্যুতি খেলা করছে।
ক্রমে ক্রমে বসা থেকে উঠে দাঁড়লো মির্জা আযম। সে ইমাম আলীর নিকটবর্তী হলো। তারপর প্রশ্ন করলো, 'তুমি মুক্তিযোদ্ধা?'
ইমাম আলী আনত চোখ তুলে তাকালো মির্জা আযমের চোখের পানে। তারপর দ্বিরুক্তি না করেই বললো, 'দেশকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে হলে যদি যুদ্ধ করতে হয়, আর সে যুদ্ধের নাম যদি হয় মুক্তিযুদ্ধ, তাহলে যারা দেশের জন্যে যুদ্ধ করে অবশ্যই তারা মুক্তিযোদ্ধা।'
হা হা হা করে হাসলো। মির্জা আযম। তার হাসির ধ্বনি দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুললো ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুললো।
হাসি শেষ হলে ইমাম আলীকে লক্ষ্য করে সে বললো, 'তুমি যদি দেশের জন্যে যুদ্ধ করে থাকো, তাহলে আমি কী করছি? আমিও তো দেশকে তোমাদের মতো সন্ত্রাসীদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যে যুদ্ধ করছি। তোমরা স্বাধীন পাকিস্তানের বুকে অশান্তি সৃষ্টি করেছ, দেশকে ভাগ করে পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন বাংলাদেশ বানাতে চাইছো। এই ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা হচ্ছে শেখ মুজিব। আমরা তোমাদের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকে ঠেকিয়ে দেশকে রক্ষা করার জন্যে যুদ্ধ করছি। সত্যিকার অর্থে আমরাই তো মুক্তিযোদ্ধা।' মির্জা আযম যেনো বক্তৃতা করতে লাগলো।
'কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে মুক্তিযোদ্ধা নয় সেটা বিচারের ভার ইতিহাসের, আমাদের নয়। ইতিহাসই একদিন বলে দেবে, কারা সত্যিকারভাবে এদেশের মানুষের সর্বাত্মক বঞ্চনার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলো, কারা আপামর মানুষের স্বপ্ন-সাধনা পূরণের জন্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলো। একদিন জাতি অবশ্যই তাদের মূল্যায়ন করবে। আর তোমরা পতিত হবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে, মনে রেখো কথাটা।' ঘৃণায়-যন্ত্রণায় মুখ থেকে যেনো কথাগুলো বেরিয়ে এলো ইমাম আলীর। তার চোখ-মুখ থেকে আগুনের ফুলকি ঠিকরে বের হচ্ছে।
ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় পড়লো ইমাম আলীর গালে। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে দেখলেন মির্জা আযম হাতটি আবারও তার গালের দিকে আনছে দ্বিতীয়বার আঘাত হানার জন্যে।
এবারও তার গালে আরেকটি থাপ্পড় পড়লো। তবে সেটি আরো জোরে। ঘৃণায়-বেদনায় কেঁপে ওঠলো ইমাম আলীর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
অপলক মির্জা আযমের দিকে তাকিয়ে আছে সে। লোকটি পাশের একজনের কাছ থেকে একটি রাইফেল হাতে নিলো। তারপর সেটা ইমাম আলীর দিকে তাক করে বললো, 'তোর ছেলে এখন কোথায় আছে বল। কোথায় যুদ্ধ করছে সে?' চোখে তার ভয়াবহ সাপের বিষ ঝরছে।
সে চোখের চাহনি পরোয়া করলো না ইমাম আলী। নিরুদ্বেগে সহজ-সরল ভাষায় বললো, 'আমি জানি, তবে বলবো না।'
'তাহলে তোকে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে মরতে হবে।' এবার পান চিবানো দাঁতগুলো বের করে ইঁদুরের মতো হাসলো মির্জা আযম।
'মৃত্যুকে ডরে বীর। জানিস না তুই?' ঘোষণা করলো ইমাম আলী।
'ওহ্, তুই তো আবার বীর! তাহলে বীর মশাই এবার বলে ফেলো তো- তোমার লক্ষ্মী, সুপুত্র ছেলেটি কোথায় আছে? বীরেরা তো কখনো মিথ্যা বলে না।' রহস্যের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো মির্জা আযম।
'হতে পারে। আমি আমার সন্তানকে দেশের জন্যে উৎসর্গ করেছি। তার জন্যে আমি গর্বিত। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি গর্বিত, আমি ...।'
মির্জা আযম রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করলো ইমাম আলীকে। সে আর বলতে পারলো না।
'শুয়োরের বাচ্চা! গর্বিত তাই না? এমন সন্ত্রাসী ছেলের জন্যে গর্ববোধ করছ? বল, কোথায় আছে সে?' মির্জা আযম যেনো হিংস্র পশুর মতো রূপ ধারণ করলো।
মাথা ফেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ইমাম আলীর। সে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। আস্তে আস্তে মাথাটা কোনোমতে ওপরে তুলে বললো, 'আমার নিজের জীবনের জন্যে আমি কোনো মায়া বোধ করছি না মির্জা আযম। আমি শুয়োরের বাচ্চা নই। আমার ছেলেও সন্ত্রাসী নয়। সে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তার কর্মের জন্যে আমি গর্বিত....।'
আর কথা বলতে দেয়া হলো না তাকে। আবারও মির্জা আযমের রাইফেলের বাঁটটি তার পিঠে আঘাত হানলো। এবার মাটিতে পড়ে গেলো সে। উঠে বসতে চাইলো কিন্তু মির্জা আযম লাত্থি মারলো। পড়ে গেলো সে। এবার মির্জা আযমের পা উঠে গেলো ইমাম আলীর শরীরের ওপর।
'আমি একজন মসজিদের মুয়াজ্জিন। তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারো না।' ক্ষীণ কণ্ঠে বললো ইমাম আলী। 'আমার বুকে কোরআনের আয়াত মুখস্থ আছে। তুমি তার অমর্যাদা করতে পারে না মির্জা আযম।'
'ওহ, তুমি তো আবার মুয়াজ্জিন সাহেব!' ইমাম আলীকে দু'হাতে ধরে দাঁড় করালো মির্জা আযম। 'তোমার সাথে বেয়াদবি করা যাবে না। ঠিক আছে, শেষবারের মতো বলছি, তোমার ছেলের ঠিকানাটা বলে দাও। তোমাকে ছেড়ে দেবো।'
'বলছি না, আমি বলবো না। তাকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছি, এটাই আমি জানি। বেশি কিছু বলতে পারবো না।'
সেই রাতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের গর্বিত পিতা ইমাম আলীকে তিনতলা থেকে রশি বেঁধে নিচে ছুঁড়ে ফেলা হলো। তার আর্তচিৎকারেও কেউ এগিয়ে আসতে পারলো না। মানুষও গ্রামশূন্য। কে আসবে।
তিনতলা থেকে পড়েও অর্ধমৃতের মতো পড়ে আছেন ইমাম আলী। আবারও রশি টেনে তোলা হলো তাকে। কিছুক্ষণ পর আবারও ফেলা হলো। আবার আর্তচিৎকার। এভাবে তিলে তিলে নির্যাতন করে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হলো তাকে। তারপর তার লাশটা রাস্তার পাশে টানিয়ে রাখা হলো পাখিদের খাদ্য হিসেবে।
পাঁচ.
রাত গভীর। চারদিকেব ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। ঝোঁপঝাড়পূর্ণ বিরাট একটা বাগানে বালিশ নয়, গাছের গুড়ির ওপর মাথা রেখে সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শুয়ে আছে স্বপ্নিল সিদ্দিকী। খানিকটা ঘুমুচ্ছে। অন্য একদল তাদের পাহারা দিচ্ছে। ওদের বিশ্রাম শেষ হলে পাহারায় নিয়োজিতরা আবার বিশ্রাম নেবে। পরদিন লোহাগড়ায় একটা অপারেশন আছে। সেখানে জয়ী হবার দৃঢ় সঙ্কল্প সবার।
স্বপ্নীল ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে। তার বাবাকে বিরাট একটা দালান থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। বার বার চিৎকার করে ওঠছে সে। সেই সাথে বিড়বিড় করে বলছে, আমি আমার সন্তানের জন্যে গর্বিত। আমার সন্তানকে আমি রেখে গেলাম দেশমাতাকে রক্ষার জন্যে। হে খোদা! তুমি আমার সন্তানকে জীবিত রেখো। তাকে যুদ্ধে জয়ী করো। সে যেনো এদেশকে স্বাধীনতা সূর্য আনয়নে নির্ভীক সৈনিক হিসেবে কাজ করতে পারে।
হঠাৎই ঘুম ভেঙ্গে গেলো স্বপ্নীল সিদ্দিকীর। উঠে বসলো সে। এমন সময় একজন সহযোদ্ধা তার পিতার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এলো। স্বপ্নে দেখা পিতার সেই গর্বিত উচ্চারণ স্মরণ হলো তার। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করলো, বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের পা চাটা কুকুরদের জীবন দিয়ে হলেও একটার পর একটা বাংলার মাটিতে পুঁতে ফেলবেই। জীবন নিয়ে তাদের ফিরতে দেয়া হবে না।
ছয়.
প্রায় শেষ রাত। কোথায়ও অপারেশনে গেছে পুরো পাক-আর্মি ব্যাটেলিয়ন। ক্যাম্পে তেমন কেউ নেই। দু'তিনজন মাত্র সৈনিক পাহারায় রয়েছে। অগ্নিমূর্তি ধারণ করা প্রতিবাদী নারীরা ক্রমে সজাগ হয়ে উঠলো। বহু চেষ্টা করে প্রায় বিনা আওয়াজে রুমের কপাট খুলে ফেললো ওরা। একটি মেয়ে কৌশলে ছলনা করে একজন সিপাহীকে নিয়ে এসে খুন করলো সবাই মিলে। কেড়ে নিলো তার মেশিনগান ও সমস্ত বুলেট।
পাক আর্মির এক কমান্ডার রাজাকার বাহিনীর অপর কমান্ডার মির্জা আযমসহ ফুর্তি করছিলো সদ্য ধরে আনা নিষ্পাপ মেয়েটিকে নিয়ে। আস্তে আস্তে কামরায় প্রবেশ করল মরিয়ম বেগম। কমান্ডার ওকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে বললো, 'এই ভাগ হিঁয়াসে।' তারপর চেঁচিয়ে বললো, 'জামাল খাঁ! ইধার আও।'
জামাল খাঁ ও ইদু মুন্সী এসে হাজির, 'কেয়া হুয়া জনাব?'
'এ লেড়কিকো লেকে যাও ইধারছে....।' আর বলতে পারলো না সে। অবাক বিস্ময়ে দেখলো, তার সামনে ক্রমে ক্রমে হাজির হচ্ছে নির্যাতিত নারীরা।
'কেয়া হুয়া, তোমারা ইধার কিঁয়ু?' সাহস করে প্রশ্ন করলো সে।
'পাকিস্তানি কুত্তা! দেখ কেনো এসেছি?' শাড়ির আড়াল থেকে মেশিনগান বের করে লোকটার বুকটা নিমিষেই ঝাঁঝরা করে দিলো মরিয়ম। লোকটার শরীর থেকে কালো কুকুরের লেজের মতো বর্ণের রক্তধারা প্রবাহিত হতে লাগলো মাটির বুকে।
এক লহ্মায় ঘটে গেলো অনেক কিছু। সৈনিকরা আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসেছিলো, মরিয়মের মেশিনগান গর্জে উঠলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ওরা চলে গেলো পরপারে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলো রাজাকার কমান্ডার মির্জা আযম। হাতের কাছে অস্ত্র ছিলো না। সে পালিয়ে যেতে চাইলো। সেই সাথে জামাল খাঁ ও ইদু মুন্সীও পালাতে চেয়েছিলো। কিন্তু মেয়েরা ধরে ফেললো তাদের।
ওদের দু'পায়ে রশি বেঁধে একটা গাছের সাথে ঝোলালো ওরা। একজন নিয়ে এলো ব্লেড। সে ব্লেড দিয়ে মির্জা আযমের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে লবণ মাখিয়ে দিলো ওরা। তার আর্তচিৎকারে আশেপাশের সব শকুন ছুঁটে এলো। মেয়েরা বললো, 'তোরা অপেক্ষা কর। এই দালালগুলোকে তোদের জন্যে উপহার হিসেবে রাখবো।'
'আমাদের প্রাণে মেরো না, দোহাই তোমাদের।' ইদু মুন্সী মরিয়া হয়ে বললো।
একদলা থুথু এসে পড়ল ইদু মুন্সীর মুখে। সে অবাক বিস্ময়ে দেখলো, নির্যাতিত একজন নারী গাছের একটা চোখা ডাল জামাল খাঁর বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। জামাল খাঁর নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে পড়ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। আরো দেখলো, মেয়েটি ক্রমে ক্রমে তার নিকটবর্তী হচ্ছে...। মরিয়ম বীরাঙ্গনার মতো মেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে নিভীর্কচিত্তে। যেনো সে আগ্নেয়গিরির সমস্ত লাভা উদ্গীরণের জন্যে তৈরি হচ্ছে।
ক্রমে ক্রমে মরিয়ম মির্জা আযমের নিকট এলো। সে ভাবতে লাগলো জীবপথের সব ভুল সিদ্ধান্তগুলো। সে ভেবেছিলো যুদ্ধের সময় এমনই হয়। মেয়েরা গণিমতের মাল হয়ে যায়। তাই সে পাকিস্তানীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছিলো। সে ভেবেছিলো পাকিস্তানীরাই মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করছে, আর বাঙালিরা দেশে অনাসৃষ্টি করছে...।
ক্রমে ক্রমে মরিয়ম আরও কাছে এলো। সে জিজ্ঞেস করলো, 'কেনো তোমরা অসহায় মেয়েদেরকে পাকিস্তানী বর্বর হায়েনাদের হাতে তুলে দাও? কেনো?' এই 'কেনো' শব্দটা যেনো মির্জা আযমের কানে অ্যাটম বোমার মতো আঘাত করলো। সে বাকশূন্য হয়ে পড়লো।
'কেনো?' অন্য মেয়েরাও গর্জে ওঠলো।
মির্জা আযম কোনো সদুত্তর দিতে পারলো না। সে দেখলো পাশের একটি গাছে অনেকগুলো বিশাল শকুন উড়ছে। ওরা অপেক্ষা করছে কখন মৃত্যু হবে তাদের।
(এ গল্পটি চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত ফরিদগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনাবলীর খণ্ডিত চিত্রাংশ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গল্পাকারে জান্তব ইতিহাস তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্য- লেখক)।